এই যে আমাদের কবিতা, গল্প, উপন্যাস, সিনেমা সব কিছুতেই সেই আদিকাল হতেই এত ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী ।
এর কারণটা কি জান ??
কারণ, সেই আদিযুগ হতেই, হারিয়ে ফেলার যে বেদনা, না পাওয়ার যে শূন্যতা, তার জন্য মানুষের মধ্যে একটা স্বাভাবিক আকর্ষন বোধ কাজ করে।
এই বোধটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের রক্তের মধ্য দিয়ে বইয়ে চলে আসছে।
আসলে কি জান, ব্যর্থতা মানুষকে খুব দূর থেকে হলেও টানে।
কথাটা হয়তো ঠিকভাবে বলা হল না। সার্বিক ভাবে ‘ব্যর্থতা ‘ কে না রেখে, বলা ভাল ‘প্রেমে ব্যর্থতা ‘ আমাদের কোনো না কোনো ভাবে আকৃষ্ট করে।
এবার একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এই ‘প্রেমে ব্যর্থতা ‘ ঠিক কাকে বলে?
এর একটা মোটামুটি উত্তর দিলে যা দাঁড়ায়, তা হল – কাউকে ভালোবেসেও না পাওয়া, কাউকে সবচাইতে কাছে পেতে চেয়েও দূরে চলে যেতে দেওয়া।
একটা জিনিষ লক্ষ করেছ কি, প্রেম ছাড়া বাকি অন্যান্য ক্ষেত্রে সফলতার গল্প বেশি স্থান পায়। সেই সাফল্যকে নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব কৌতুহল ও মাতামাতি দেখতে পাওয়া যায়।
কিন্তু প্রেমের ক্ষেত্রেই ঠিক এর উল্টো।
প্রেমের ক্ষেত্রে মনে হয়, ব্যর্থতার কাহিনী, অসফলতার গল্প অনেক বেশি স্থায়িত্ব পেয়েছে চিরটাকাল।
আর এরই প্রতিফলন আমরা দেখেছি শিল্পের সব ধারায়।
প্রেমের ব্যর্থতার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে এর সাফল্য, আর প্রেমের সফলতা কোথায় গিয়ে যেন এক ধরনের ব্যর্থতাই।
যে প্রেম শেষ হয়েছে না পাওয়ায়, যে প্রেম পরিণতি হিসাবে পেয়েছে হারিয়ে ফেলাকে, তাকেই কেন যেন মনে রাখতে চেয়েছে মানুষ, তারই যন্ত্রণায় মেতে উঠেছে বারবার।
যে প্রেম তথাকথিত ভাবে সফল, তার কথা কি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতে চেয়েছে কেউ ?
শুধু পাঠক, শ্রোতা বা দর্শকদের কথা বাদ দিলেও কবি, লেখক, নাট্যকার, প্রমুখ স্রস্টারাও কি সফল প্রেমের গল্প বলেছেন বেশিবার?
স্কুল জীবন থেকে এ গলি সে গলি ঠোক্কর খেতে খেতে যে প্রেম পরিণতি পেল বিয়ের আসরে, তাকে নিয়ে কারোর আদৌ কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। বরং ভাবটা এমন – ” এ তো হয়েই গেল।”
অর্থাৎ প্রেমটা ভেঙে গেলে যাও বা একটা হারিয়ে ফেলার বেদনা, না পাওয়ার কষ্টের কাহিনী হতে পারত, তারও সুযোগ রইল না আর।
যেন বিয়ের পর প্রেম ব্যাপারটাই তুচ্ছ আর ব্রাত্য হয়ে পড়লো।
আমরা এটা একদম নিশ্চিত হয়ে যাই যে, বিয়ের পর যেন আর আগের মত সেরকম প্রেম কোনোদিন থাকতেই পারে না।
আসলে বিয়ে একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তাই বিয়ের পর, ছেলে মেয়ে , বলতে পারো ভূতপূর্ব প্রেমিক প্রেমিকা প্রেমের সম্পূর্ণ বৈধতা পেয়ে যায়, হারানোর কোনো আর ভয় থাকে না, তাই সেটা আমাদের কাছে আর প্রেম বলে গণ্য হয় না।
আর অন্য দিকে বিয়ের পূর্বে অবৈধ সম্পর্ক, হারানোর ভয় ইত্যাদি থাকে বলে আমাদেরও সেদিকে আগ্রহ থাকে বেশি।
মূল কথা হচ্ছে, যুগ যুগ ধরে পাওয়ার আনন্দের চাইতে না পাওয়ার কষ্টটাকে অনেক বেশি উপভোগ করছি আমরা, উদযাপন করছি।
এই যে আমাদের গল্পে, গানে, সিনেমায়, সাহিত্যে ব্যর্থ প্রেমের চিরকালীন জনপ্রিয়তা, সেখানে পুরোটাই শুধু ‘ ব্যর্থ প্রেমিক ‘।
একটি মেয়ে একটি ছেলেকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, এই দিয়েই প্রায় সবকটা গল্পের শুরু হয়।
ছেলেটির অসহ্য কষ্টে আমরাও কষ্ট পাই।
কিন্তু যে মেয়েটি ছেড়ে চলে গেলো, তারও যে একইরকম কষ্ট হচ্ছে না, সেটাই বা কে জানে?
হয়তো সে ছেলেটার ভালোর জন্য, নিজের পরিবারের জন্য কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই হোক নিজের বুকে পাথর রেখে তার প্রিয় মানুষটাকে ছেড়ে চিরদিনের মত চলে যাচ্ছে।
সেদিকের খোঁজ আমাদের কলম, ক্যামেরা খুব কমই রাখে, প্রায় না এর বরাবর।
আসলে সত্যি কথা বলতে, আমাদের এই সমাজটা পুরুষতান্ত্রিক বলেই, সমস্ত গল্পের ট্র্যাজেডিক হিরো শুধুমাত্র পুরুষদেরকেই বানানো হয়।
এই সমাজের মতানুসারে, আর যাই হোক, ছেড়ে যাওয়াটা শুধুমাত্র মেয়েদেরকেই মানায়।
কিন্তু আসল কথা কি জান, আমাদের গল্পে, কাহিনী বা সিনেমায় পুরুষদেরকে যতই ট্র্যাজেডিক হিরো বানানো হোক না কেন, আসল মহিমা কিন্তু সেই মেয়েদেরই।
সব গল্প, কাহিনীতে কেবল সেই নারীই রয়েছে ‘ তুমি ‘ হয়ে, ‘ আরাধ্যা ‘ হয়ে, ‘ অভিশাপ ‘ আর ‘ কালপ্রিট ‘ হয়ে।
নারী না থাকলে সেই ট্র্যাজেডিক হিরোটাই বা কিভাবে উদয় হত?
আসল কথা, সব কিছুর মুলেই কিন্তু সেই নারী।